টোকিও ট্রাইব্যুনালে জাস্টিস পালের মনোনীত হওয়ার পথটি মসৃণ ছিল না। মিত্রশক্তির বিভিন্ন দেশ থেকে দশ জন বিচারপতি নিয়োগ হয়ে গেলে ব্রিটিশদের সর্ববৃহৎ উপনিবেশ ভারত থেকে একজন বিচারপতি নিয়োগ করার দাবি ওঠে। কেননা ভারত যেহেতু প্রত্যক্ষভাবে জাপান কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছিল সেহেতু তার সম্মান বজায় রাখার জন্যে ব্রিটিশ ভারত সরকার তাদের মনোনীত একজন বিচারক প্রেরণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ ভারত সরকার জাস্টিস পালকে প্রথমেই প্রেরণ করতে ইচ্ছুক ছিল না। একারণে টোকিও ট্রাইব্যুনালে ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে তারা প্রথমে মনোনীত করে বোম্বে হাইকোর্টের (মুম্বাই) সাবেক বিচারপতি ওয়াদিয়া (Wadia) কে। কিন্তু জাস্টিস ওয়াদিয়া এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। এরপর তারা মনোনীত করে এলাহাবাদ হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি ভার্মাকে। জাস্টিস ভার্মাও এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃপর ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার মনোনীত করেন কলকাতা হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি রাধাবিনোদ পালকে। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শুরু হওয়ার মাত্র ছয় দিন আগে তাঁকে মনোনীত করা হয়। এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনালের অপরাপর বিচারপতিদের মধ্যে একটা গোপন মিমাংসা হয়ে য়ায়; আর তা হলো: “চূড়ান্তভাবে রায় ঘোষণার আগে এককভাবে কোনো বিচারপতি অসম্মতি দিতে পারবে না এবং বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা জনসম্মুখে বলতেও পারবে না।” এই প্রস্তাবটি ছিল নেদারল্যান্ডের বিচারপতি বার্ট রোলিং-এর। তিনি ছিলেন এই ট্রাইব্যুনালের সর্বকনিষ্ঠ বিচারক। তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩৯ বছর। ০৩ মে ১৯৪৬ তারিখে ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য আরম্ভ হয়। বিচারকার্য শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ পরে জাস্টিস পাল ভারত থেকে জাপানে এসে পৌছান। তিনি ট্রাইব্যুনালে যোগ দিয়ে ট্রাইব্যুনালের চার্টার বা সনদ পাঠ করে এই চার্টার বিষয়ে আপত্তি উপস্থাপন করেন। বিচারপতিদের মধ্যে তিনিই প্রথম ট্রাইব্যুনালের চার্টার বা সনদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি আসলে ট্রাইব্যুনালের মূলনীতির সঙ্গেই অসম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন। এই চার্টার তৈরি করেছিলেন ২য় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র শক্তির প্রধান সেনাপতি ডগলাস ম্যাকআর্থার বিচার শুরু হওয়ার চার মাস আগে। এতে সম্পূর্ণ নূতন দুই ধরনের যুদ্ধাপরাধের ধারা সংযুক্ত করা হয়েছিল। নূতন দুইটি ধারা হলো : ১. Crime against peace; ২. Crime against humanity। ধারা দুইটি আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সম্পূর্ণরূপে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। জাস্টিস পাল চার্টারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বলেন, “অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা ঐ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধাপরাধ ছিল না এবং এটা বেঠিক।” ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট জাস্টিস ওয়েব এই প্রতিবাদ প্রত্যাখ্যান করেন এবং অন্যান্য বিচারপতিরা এতে মর্মাহত হন। ব্রিটিশ ভারতের সরকারের কাছেও জাস্টিস পালের এই আচরণ অপ্রত্যাশিত ছিল।
৫ জুলাই ১৯৪৬ তারিখে জাস্টিস পাল ট্রাইব্যুনালের অন্যান্য বিচারতিদের কাছে একটি মেমো পাঠিয়ে বলেন যে, “অভিযুক্তদেরকে নতুন সংজ্ঞায়িত যুদ্ধাপরাধ দ্বারা বিচার করা যেতে পারে না।”তিনি আরও বলেন, “New laws cannot be enforced rectoractively to deam legal acts at that time as a crime postfactom is unacceptable।”
১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাস থেকে মিত্রশক্তি ট্রাইব্যুনালে নানকিং ম্যাসাকার সম্পর্কে সাক্ষী ও প্রমাণ উপস্থাপন শুরু করে। ইতোমধ্যে বিচারপতিদের মধ্যে মতভেদের গুঞ্জন তীব্র হতে আরম্ভ করল। জাস্টিস পাল একাই একদিকে থেকে প্রকাশ্যে চার্টারের বিরোধিতা শুরু করেন। অপরদিকে ব্রিটেনের বিচারপতি লর্ড প্যাট্রিক জাস্টিস পাল-এর বিরোধিতা ও প্রতিবাদ করে বলেন, “বিচারপতিদের অবশ্যই চার্টারের প্রতি অনুগত থাকতে হবে।”১১ই অক্টোবর লর্ড প্যাট্রিক ট্রাইব্যুনালের সকল বিচারপতির উদ্দেশ্যে চার পৃষ্ঠার একটি মেমো প্রেরণ করে বলেন, “এই চার্টারের প্রতি অনুগত থাকা ট্রাইব্যুনালের সকল বিচারপতির জন্যে বাধ্যতামূলক। যারা এই চার্টারের প্রতি আপত্তি উপস্থাপন করেছে তারা যেন টোকিও ত্যাগ করে।” তিনি লেখেন, ÔAll judges must abide by the charter. Whoever cannot abide by the charter should tender his resignation. To stay honest, Judge who are questioning the charters power indemse is an act of ÒfraudÓ against the allies। জাস্টিস পাল নীরব থাকলেন না। ছয় দিন পরে তিনি সকল বিচারপতিদের উদ্দেশ্যে নতুন একটি মেমো প্রেরণ করলেন। এই মেমোতে তিনি দারুণভাবে লর্ড প্যাট্রিকের সমালোচনা করেন। তিনি লেখেন, “Concerning the memo of my esteem colleague Justice Patrick I must confess, I do not agree with him in any of his views. Justice Patrick’s opinion urging a fellow judge to resign certainly appears someone misplaced in a note for the tribunals|”
১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে মিত্রশক্তিপক্ষ জাপানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থাপন শুরু করে। অভিযোগগুলি হলো: ১. জাপান কর্তৃক মাঞ্চুরিয়া ও চীন জুড়ে যুদ্ধ শুরু করা; ২. প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা; ৩. ব্রিটিশ, ডাচ এবং এদের উপনিবেশগুলিতে যুদ্ধ শুরু করা। মিত্রপক্ষ আরও অভিযোগ করে যে, জাপানের নেতারা কেন্দ্রীয় পূর্বপরিকল্পনা মাফিক এই যুদ্ধ আরম্ভ করেছে এবং এটা একটা ÔConspiracyÕ বা ‘ষড়যন্ত্র’। ÔConspiracyÕ শব্দটা এখানে ব্যবহৃত হয়েছে একটা অ্যাংলো-আমেরিকান কনসেপ্ট হিসেবে ‘কাউকে দোষী হিসেবে অভিযুক্ত’ করার জন্যে।
ইতোমধ্যে জাস্টিস পাল নিজেকে টোকিওর ইম্পেরিয়াল হোটেলে নিজ কক্ষে নিজেকে আবদ্ধ রাখেন এবং আন্তর্জাতিক আইনের ওপর গভীরভাবে অধ্যয়ন আরম্ভ করেন। এই সময়ে তিনি আন্তর্জাতিক আইনের সাথে ট্রাইব্যুনালের চার্টারের বৈপরীত্য এবং জাপানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর ওপর নোটসহ ২৫৭ মতান্তরে ২৬০ পৃষ্ঠার নিজস্ব অভিমত লেখেন। জাস্টিস পাল মিত্রশক্তির এই অভিযোগ খারিজ করে দিয়ে বলেন, “কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে আইনগতভাবে ষড়যন্ত্র বলে অভিযুক্ত করে বিচার করা যায় না।” তিনি আইনগত ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ÔConspiracy is not a crime according to international law.’ এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাঁর রায়, ÔI would dismiss all the counts based on this accusation
আবার বিচারপতিদের মধ্যে মতবিরোধ শুরু হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় লর্ড প্যাট্রিক ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটিশ সরকারের কাছে এই মর্মে অভিযোগ করে প্রতিবেদন পাঠান যে, ÔThe Indian judge circulated a memo of 260 pages. Whyever the government of India appoints this man and why did our government support this? I fail to understand why?Õ ইতোমধ্যে জাস্টিস প্যাট্রিক কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের বিচারপতিকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন। ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট জাস্টিস ওয়েব বেঞ্চের ভিতর ঐক্য আনতে ব্যর্থ হন এবং জাস্টিস প্যাট্রিক, জাস্টিস ম্যাকডুগাল ও জাস্টিস নর্থক্রফট এর প্রতি ক্ষুব্ধ হন। এমন পরিস্থিতিতে জাস্টিস প্যাট্রিক, জাস্টিস ম্যাকডুগাল ও জাস্টিস নর্থক্রফট নিজেদেরকে সংখ্যালঘু হিসেবে ভাবতে শুরু করেন এবং দুর্বল অবস্থানে চলে যান কিন্তু জাস্টিস পাল নিজের অবস্থানে অনড় থাকেন। জাস্টিস প্যাট্রিক ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করে লিখলেন, যেন সরকার তাদের তিনজনকে প্রত্যাহার করে নেয়। এর প্রত্যুত্তরে ব্রিটিশ পররাষ্টমন্ত্রী আর্নেস্ট বেভিন তাকে জানান যে, ব্রিটিশ সরকার টোকিও ট্রায়ালকে পরিত্যাগ করবে না কারণ এটা করলে তা ইউরোপীয়দের সম্মানের ক্ষেত্রে একটা বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়াবে এবং জাস্টিস প্যাট্রিক যে প্রস্তাব করেছেন তা ভুল। জাস্টিস প্যাট্রিক ভাবলেন অন্যান্য বিচারপতিদেরকে নিজের পক্ষে আনার জন্যে নিজেকেই চেষ্ট করতে হবে। এরই মধ্যে জাস্টিস পাল নেদারল্যান্ডের বিচারপতি বার্ট রোলিংকে নিজের মতানুবর্তী করতে সক্ষম হন। এটা সম্ভব হয়েছিল এই কারণে যে, জাস্টিস রোলিংও মনে করতেন লঘু হলেও কারও মত প্রকাশে বাধা দেওয়া উচিত নয়। ট্রাইব্যুনালের বেঞ্চে তিনি ও জাস্টিস পাল পাশাপাশি বসতেন। জাস্টিস পাল জাস্টিস রোলিং কে এটা বুঝাতে সক্ষম হন যে, ÔJudges from the victors countries are seized by feelings, hates and revenges. So, they are soon prepared to accept aggressive war as a crime after the fact|Õ জাস্টিস রোলিং এটা বুঝেছিলেন এবং সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়কে না মানতে এবং নিজের অভিমতকে প্রকাশ করতে কিন্তু তাঁর সরকার তাঁকে বলেছিল মেজরিটির রায়কে সমর্থন করতে।
১৯৪৮ সালের গ্রীষ্মকালে ট্রাইব্যুনাল সাক্ষ্য ও প্রমাণ গ্রহণের পর মুলতবি ঘোষণা করে। ১২ নভেম্বর ১৯৪৮ তারিখে ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করে। আট জন বিচারক রায় দিলেন জাপান দোষী। তাঁদের দৃষ্টিতে জাপান কর্তৃক এই যুদ্ধের পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, আরম্ভ ও বাস্তবায়ন ছিল ‘শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ’ বা ÔCrime against peaceÕ এবং ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বা ÔCrime against humanity। ÔCrime against peaceÕ Class-A শ্রেণির যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য। জাপান সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের সদস্যরা ছিলেন এই অভিযোগে অভিযুক্ত। এদের সংখ্যা ছিল ২৮ জন। Crime against humanity Class-B ও Class-C শ্রেণির যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত। জাপানের ইম্পেরিয়াল আর্মির অফিসার ও সৈন্যরা যারা যুদ্ধকালে প্রথাগত নৃশংসতা ও অমানবিকতার সাথে জড়িত ছিল তারা এই অভিযোগে অভিযুক্ত। এদের সংখ্য ছিল ৭,৫০০ জন। এর পাশাপাশি বিচারকদের দৃষ্টিতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের অংশগ্রহণ ও পার্ল হারবার আক্রমণ ছিলো ÔAn war of aggression’ । ট্রাইব্যুনালের ১১জন বিচারকের মধ্যে আট জন বিচারক ২৮ জনকে অভিযুক্ত হিসেবে ঘোষণা করে এবং পাঁচ জন অভিযুক্তকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট জাস্টিস ওয়েব তিন জন বিচারপতির (পাল, রোলিং ও বার্নার্ড) ‘ভিন্নমত’ রায় গ্রহণ করেন কিন্তু প্রকাশ্য আদালতে রায় পাঠ করা থেকে বিরত থাকেন। জাস্টিস পাল জাস্টিস ওয়েবের কাছে চিঠি লিখে উন্মুক্ত কোর্টে তাঁর রায় পাঠ করার অনুমতি চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি অনুমতি পাননি।
প্রকাশ্য আদালতে রায় পাঠ করার সুযোগ না পেয়ে জাস্টিস পাল নিজের হাতে লেখা ও সংশোধন করা ১২৩৫ পৃষ্ঠার রায়ের কপি নিয়ে নিজ দেশে ফেরত আসেন। কিন্তু তাঁর রায় ঠিকই রাষ্ট্র হয়ে গেল। তিনি “Not Guilty” রায় দিয়েছিলেন অর্থাৎ জাপান নির্দোষ। ২৮ জন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীকে তিনি Class-A শ্রেণির যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ হতে খালাস দিলেন। তিনি শুধু ‘নির্দোষ’ রায়ই দিলেন না; যুক্তি, তথ্য, উপাত্ত উপস্থাপন করে দেখিয়ে দিলেন জাপান কর্তৃক যুদ্ধে অংশগ্রহণ আগ্রাসী যুদ্ধ ছিল না, বরং আত্মরক্ষার জন্যেই জাপান যুদ্ধ করেছে। তিনি দেখান ১৯৩১ সালের মাঞ্চুরিয়ার ঘটনা, ১৯৩৭ সালের মার্কো পোলো ব্রিজের ঘটনার মাধ্যমে জাপান জড়িয়ে পড়েছিল Sino-Japanese যুদ্ধে এবং ১৯৪১ সালে আমেরিকা ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডের উস্কানিতে জাপান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। তাঁর দেওয়া ১২৩৫ পৃষ্ঠার ঐতিহাসিক রায় মিত্রশক্তি এমনকি সমগ্র বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। কেননা দীর্ঘ ১২৩৫ পৃষ্ঠার রায়ে দেয়া তাঁর বক্তব্যের যুক্তি ও সারবস্তু উপেক্ষা করা সহজ ছিল না। যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে জাপান দোষী প্রমাণিত হয় ফলে মন্ত্রী, সেনাপতি ও রাজনীতিবিদসহ পাঁচ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং অনেককে দীর্ঘ মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আইনের শাসনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল বিচারপতি পাল মিত্রশক্তির পক্ষে রায় প্রদানকারী আট জন বিচারপতির রায়কে অসার প্রমাণের জন্য ৩ টি বিষয় উপস্থাপন করেন। ক. মিত্রশক্তির তিন প্রধান কর্তৃক স্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দ্রুত স্তিমিতকরণে প্রথাগত অস্ত্রের অনুশীলন সম্পর্কিত ঘোষণা। খ. আন্তর্জাতিক আইনের সংযম ও নিরপেক্ষতার নীতিমালা লংঘন। গ. জাপানের আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত উপেক্ষা করে ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টিকারী আণবিক বোমা ব্যবহার। এই রায়ে তিনি জাপানকে তার মহাভুলের জন্য যেমন দায়ী ও সমালোচনা করেছেন, তেমনি শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমেরিকা ও ব্রিটেনের মুখ থুবড়ে দিয়েছেন। এশিয়া মহাদেশে শ্বেতাঙ্গরাই যে প্রথম আগ্রাসী শক্তি ছিল তিনি তা রায়ে সুস্পষ্টভাবেই দেখিয়ে দিয়েছেন। তাঁর প্রদত্ত যুক্তিগুলো তখন খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বিশ্বের প্রধান সংবাদপত্রগুলো তাঁর রায়কে শিরোনাম করে সংবাদ পরিবেশন করে। রাতারাতি তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। মূলত আন্তর্জাতিক আদালতের এই বিচারকার্যই তাঁকে বিশ্বজোড়া সুখ্যাতি এনে দেয়।
জাস্টিস পালের প্রদত্ত রায়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায় তাঁর জীবনদর্শনের আলোকে যুক্তিগুলো লিখিত ও উপস্থাপিত হয়েছে; যার বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছে পশ্চিমা উপনিবেশবাদের তীব্র সমালোচনা। সেখানে তিনি বলেন, ÔWestern countries command territories in eastern hemisphere solely because they have secured the land through armed violence. If properly scrutinized none of these colonial wars would stand the test of being just war|Õ তাঁর বিচারে, ÔJapan was innocent according to international lawÕ| এই বিচারকার্যে নিজের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ÔI didn’t spent a single moment in any other thing. I didn’t see anything of Japan during the trial period. When whole time was devoted to the preparation of this judgement|Õ
জাস্টিস পাল ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বিচারক। তিনি প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন টোকিও ট্রাইব্যুনাল ছিল বিজিতের ওপর বিজয়ীর বিচার এবং এই বিচারের রায় জাপানীদের ও জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর বড় একটা প্রভাব ফেলবে। তাঁর দৃষ্টিতে, ÔJapanese school textbook would use the historical notion created by the Tokyo trial to teach that, Japan committed the crime of aggressive violence and Japan committed an international crime|’ এমতাবস্থায় নিজের করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ÔI cannot stand idly by and watch future generations of Japanese children be burdened with a warped sense of guilty which infects them with servility and decay|’ যুদ্ধে পরাজয় বরণের পর জাপান তার আত্মবিশ্বাস হারিয়েছিল এবং জাপানের জনগণ তাদের আত্মপরিচয় খুঁজতে ছিল ভাবাদর্শগতভাবে এবং সাংস্কৃতিগত দিক থেকে। এই সময় জাস্টিস পালের এই রায় তাদের মনে সাহস ও আশা জাগিয়েছিল। সম্ভবত এই কারণে জাপানে তাঁর এত সম্মান। কয়েক বছর আছে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে ভারত সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বলেছিলেন, “জাপানের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরাই কেবল নয়, জাপানের প্রত্যেকটি শিশুও জাস্টিস পালের নাম জানে এবং তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।” তবে জাস্টিস পাল বুঝতে পারেন না যে, কেন জাপান যুদ্ধ ঘোষণা করতে গেল। তাঁর জিজ্ঞাসা, ÔNo more than Japan is a beautiful country. I am enforced to question why is the people born in and raised in such a lovely nature should ever consider waging war?
টোকিও ট্রাইব্যুনাল শেষ হওয়ার পর জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইংরেজিতে একটা পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল এবং সেখানে তারা জাপানের ‘পাপ’এর জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল; এমনকি তারা টোকিও ট্রায়ালের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছিল। এশীয় মূল্যবোধ অনুসারে ক্ষমা চাওয়ার এই প্রক্রিয়াটি ছিল জাপানের জন্যে খুবই পীড়াদায়ক। এটা দেখে জাস্টিস পাল বলেছিলেন, “জাপান কেন দাঁড়াতে পারবে না? কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল?” ১৯৫২ সালে জাপানের হিরোশিমায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে সভাপতিত্ব করতে গিয়ে তিনি পারমাণবিক বোমা হামলায় নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ (Cenotaph)-এ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন ও নিরব প্রার্থনা করতে যান। সেখানে তিনি দেখেন স্মৃতিস্তম্ভের শিলালিপির গায়ে জাপানি ভাষায় কিছু একটা লেখা আছে। তিনি সাথে থাকা অনুবাদককে বলেন এটা অনুবাদ করে শুনাতে। সেখানে লেখা ছিল ÒLet all the souls here rest in peace, For we shall not repeat the fault.Ó এটা শুনার পর তিনি বলেন, “নিশ্চিতভাবেই এখানে ‘We’ বলতে জাপানিদের বুঝানো হয়েছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না এখানে ÔThe faultÕ দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে। এখানে যে আত্মাগুলো শায়িত আছে তারা তো পারমাণবিক বোমা হামলার শিকার। আমার কাছে এটা পরিষ্কার যে জাপানিরা এই বোমাটা নিক্ষেপ করেনি এবং যারা এই বোমাটা নিক্ষেপ করেছে তাদের হাতে রক্তের দাগও রয়েছে। যদি এই শব্দগুচ্ছ Ôwe shall not repeat the faultÕ দ্বারা তাদেরকে বুঝায় যারা বোমা হামলার জন্যে দায়ী, তাহলে এই শিলালিপি একটা সত্য অর্থ ধারণ ও প্রকাশ করে। আর যদি ÔThe faultÕ দ্বারা বৃহত্তর পূর্ব এশীয় যুদ্ধকে বুঝায়, তাহলে আমি আরও একবার বলছি ‘জাপান এই দোষ থেকে মুক্ত।” তিনি আরও বলেন, পশ্চিমা এবং ইউরোপীয় দেশগুলো যারা এশিয়াকে দখল করেছিল তারা এই যুদ্ধের বীজ বপন করেছিল। তা ছাড়া আমেরিক, ব্রিটেন, চীন, নেদারল্যান্ডস চক্র জাপানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল এমনকি তারা তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাপানকে উস্কানি দিয়েছিল এবং ÔHull NoteÕ আকারে চরমপত্রও দিয়েছিল। এটা কি পরিষ্কার নয় যে আমেরিকাই এই যুদ্ধের জন্যে দায়ী। তিনি আরও বলেছিলেন, ÒThe Tokyo Trial was conducted by demagogues of wartime propaganda. The purpose of the trial was to Implicate Japan as responsible for all wrongdoings. I would never believe how such deceit has crushed the spirit of the Japanese people. The Tokyo Trial has inflicted even greater damage than the atomic bomb.”
জাস্টিস পাল ছিলেন শান্তিবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির প্রতি ছিল তাঁর গভীর আস্থা। তিনি মানুষকে ভালোবেসেছেন, যুদ্ধ ও ঔপনিবেশিক শাসনকে ঘৃণা করেছেন এবং ন্যায় বিচারের প্রতি রেখেছেন প্রবল আস্থা। তাঁর ভাষায়, ÔWhen time shall have soften passion and prejudice, When reason shall have stripped the mask from misinterpretation, then justice holding evenly her scales, will require much of past censure and praised to change places.’
মো. জাবেদ ইকবাল
সহকারী অধ্যাপক
বাংলা বিভাগ
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ
ইতিহাসের বিস্মৃত বাঙালি বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল – ১ম পর্ব।
ইতিহাসের বিস্মৃত বাঙালি বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল – ২য় পর্ব।
মূল্যায়নের মরীচিকায় অবমূল্যায়িত প্লেটো।
৭ই মার্চের ভাষণ: স্বাধীনতার ওঙ্কার।