বিংশ শতাব্দীতে যে কয়েকজন বাঙালি বিশ্বকে তাক লাগিয়েছেন, কাঁপিয়েছেন; তাঁরা হলেন : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সার্ভেয়ার রাধানাথ শিকদার, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল, প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ। এঁদের মধ্যে বিশ্বে আজও যিনি সদর্পে প্রভাব বিস্তার করে আছেন তিনি বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল (১৮৮৬-১৯৬৭) —যাঁর সম্পর্কে বাঙালি তেমন জানে না বললেই চলে। ‘জাস্টিস পাল’ নামে যিনি বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। মাত্র হাতে গোনা যে কয়েকজন সাহসী পুরুষ মানবজাতির ইতিহাসকে মহিমান্বিত করেছেন, নিঃসন্দেহে বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের মধ্যে অন্যতম একজন বাঙালি; বাঙালি জাতির অহংকার।
টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালখ্যাত জাস্টিস পালের জীবন-সংগ্রাম বাস্তবতাকে তো বটেই খোদ রূপকথাকেও হার মানায়; বিস্ময়াভিভূত করে। তাঁর জন্ম ১৮৮৬ সালের ২৭ জানুয়ারি অবিভক্ত ভারতের নদীয়া জেলায়; বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার মৌজা সালিমপুরের অন্তর্গত তারাগুনিয়া গ্রামে মাতুলালয়ে এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হন কলকাতায়। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ঐ জেলার মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের নিভৃত পল্লি কাকিলাদহের বর্তমানে জজ পাড়ায়। পাড়াটির নাম ‘জজ পাড়া’হয় তাঁর পদবি অনুসারে। কারণ এলাকার লোকের কাছে তিনি ‘জজ সাহেব’নামে এখনও পরিচিত। তাঁর পিতার নাম বিপিন বিহারী পাল। তাঁর পিতা ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র। মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি পিতাকে হারান। অকাল বিধবা মা মাত্র ৩ বছরের শিশুকে নিয়ে স্বামীর দাদা বৈদ্যনাথ ও কালীনাথ পালের আশ্রয়ে ওঠেন। কিন্তু বেশি দিন থাকতে পারেননি। সাড়ে ৪ বছরের শিশু সন্তান রাধাবিনোদ পালকে নিয়ে মা স্বামীর ভিটে ছেড়ে চলে যান চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী গ্রামে। কুমারী গ্রামে দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে ঝি’র কাজ করতেন তাঁর মা। আর রাধাবিনোদ পালের ওপর অর্পিত হয় ওই গৃহস্থের বাড়িতে ‘মাহেন্দার রাখাল’এর কাজ। শিশু রাধাবিনোদ পাল এখানে হয়ে উঠেন কিংবদন্তির রাজকুমার। তাঁকে নিয়ে বেশ কিছু কাহিনি মিথের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঐ এলাকার বিস্তৃত জনপদে। একটা গল্প এরকম : রাধা বিনোদ পালের গৃহস্থের বাড়িতে চুল কাটতে এসেছে এক নাপিত বছর ভিত্তিক চুক্তিতে। পরিবারের সকলের চুল কাটানো শেষ হয়ে গেলে রাধাবিনোদ পালকে তাঁর মা নাপিতের নিকট নিয়ে গিয়ে চুল কেটে দিতে অনুরোধ করেন। নাপিত চুল কাটার পর যথারীতি পারিশ্রমিক চাইলে সহায় সম্বলহীন মা পয়সা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এতে ক্ষুব্ধ নাপিত এক অবাক কাণ্ড করে বসে! সে রাধাবিনোদ পালকে আবার ধরে এনে মাথা মুড়িয়ে দেয়।
কুমারী গ্রামে কিছুকাল কাটিয়ে রাধাবিনোদ পালের মা স্বীয় আত্মজকে নিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মোড়ভাঙ্গা গ্রামে তার আরেক দুঃসম্পর্কের অবস্থা সম্পন্ন আত্মীয় কৃষ্ণবন্ধু পালের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এখানেও তাঁকে রাখালের কাজ করতে হত। সারাদিন গরু, ছাগল, ভেড়া চরিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন তিনি। রাতে মনিবের সন্তানদের পাশে বসে তাদের লেখাপড়া করা দেখতেন। তাদের লেখাপড়া দেখে তিনি নিজে নিজেই ভালভাবে লেখা শিখে গেলেন। তিনি মনিবের ঘরের মাটির দেয়ালে চুরি করে কয়লা দিয়ে লিখতেন। ছবি আঁকতেন। একদিন মনিব কৃষ্ণবন্ধু পাল এটা জানতে পেরে নিজ সন্তানদের সাথে রাধাবিনোদ পালকেও লেখাপড়ার সুযোগ করে দেন এবং পার্শ্ববর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথপুরের গোলাম রহমানের টোলে ভর্তি করে দিলেন। পড়ালেখার প্রতি তাঁর একাগ্রতা দেখে কৃষ্ণবন্ধু পাল মুগ্ধ হন। কৃষ্ণবন্ধু পাল মাঝে মাঝে কুমারীর জমিদার শৈলেন সাহার বাড়িতে যেতেন। একদিন তিনি শৈলেন সাহাকে রাধাবিনোদ পালের পড়ালেখার প্রতি গভীর অনুরাগ আর একাগ্রতার গল্প বলেন। সব শুনে জমিদার শৈলেন সাহা তাঁকে নিজ আলয়ে নিয়ে আসেন এবং সেখানে অবস্থানের সুযোগ দিয়ে কুমারী গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। এই পাঠশালার নাম পরবর্তীকালে কুমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে পরিবর্তিত হয়। তৎকালে সম্ভবত স্কুলটির নাম ছিল কুমারী এম. ই স্কুল।
জীবন সংগ্রামের পাশাপাশি এগিয়ে যায় রাধাবিনোদ পালের শিক্ষাজীবন। বস্তুত তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের শুরু হয়েছিল এই কুমারী গ্রামের পাঠশালায়। সেখানে সহপাঠীদের চেয়ে অধিকতর বেশি প্রতিভার পরিচয় রাখেন তিনি। এলাকায় কথিত আছে যে, ওই পাঠশালায় তিনি তিন বছর পড়ালেখা করেন। এরপর তিনি পার্শ্ববর্তী বাঁশবাড়িয়া গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি হন। তাঁর অমিত প্রতিভার পরিচয় প্রত্যক্ষ করে এ সময় অনেকেই তাঁর দিকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন কুষ্টিয়া হাই স্কুলে। তিনি কুষ্টিয়ায় এক বোর্ডিং-এ অবস্থান করে পড়ালেখা করতেন। সে সময় তিনি পার্ট টাইম বাবুর্চির কাজ করে বোর্ডিং-এ থাকার খরচ যোগাড় করতেন। এই বিদ্যালয় থেকে তিনি মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। পরীক্ষায় তাঁর অসামান্য ফল সমগ্র নদীয়া জেলায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ঈর্ষণীয় সাফল্যের সাথে তিনি রাজশাহী ওল্ড কলেজ থেকে ১৯০৫ সালে F.A (First Arts বর্তমানে Intermediate বা I.A) পাশ করেন। ১৯০৭ সালে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিসহ গণিতে স্নাতক সম্মান ডিগ্রি লাভ করেন। পরের বছর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিসহ গণিতে এমএসসি ডিগ্রি এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯২০ সালে আইন বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ও ১৯২৫ সালে আইনে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এককথায় কেবল মেধা আর অধ্যবসায়ের জোরে নিজের বৃত্তির অর্থ এবং বিভিন্ন সময়ে নানা জনের বাড়িতে আশ্রিত থেকে রাধাবিনোদ পাল জীবনে শুধু প্রতিষ্ঠিত নয়; দেশে-বিদেশে খ্যাতিও অর্জন করেছেন।
দরিদ্র পরিবারের অনাথ সন্তান হিসেবে শিশুকাল থেকেই শুরু হয় রাধাবিনোদ পালের অনানুষ্ঠানিক কর্মজীবনের। ‘মাহেন্দার রাখাল’ হিসেবে গৃহস্থের বাড়িতে কাজ করে তাঁকে সংসার দেখতে হত শৈশব থেকেই। আনুষ্ঠানিক কর্মজীবনের শুরুতে তিনি প্রথম দুই বছর এলাহাবাদ ‘অ্যাকাউনটেন্ট জেনারেল’এর অফিসে করণিক ছিলেন এবং এই সময় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে B. L পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি গণিতে অনার্স পাশ করার পর ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে ১৯১১-১৯২০ সাল পর্যন্ত ৯ বছর অধ্যাপনা করেন। ১৯২০ সালে আইনে স্নাতকোত্তর (M. L) ডিগ্রি লাভের পর তিনি আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনা ছেড়ে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন; যদিও এর আগেই তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন। শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি ১৯২১ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আইন ব্যবসায় যুক্ত হন। আইন ব্যবসায় তিনি অল্প দিনের মধ্যেই বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯২৩-১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯২৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে D. L (ডক্টর অফ ল, বর্তমানে পিএইচ. ডি) ডিগ্রি প্রদান করে, তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘Hindu Philosophy of Law in the Vedic and Post Vedic Times prior to the Institutes of Manu’। আইন পেশায় নিয়োজিত থেকে ১৯২২ সালে প্রণীত ভারতবর্ষের আয়কর আইনের সময়োপযোগী সংস্কার করেন। ১৯২৭ সালে ব্রিটিশ ভারত সরকার তাঁকে লিগ্যাল অ্যাডভাইজার পদে নিযুক্ত করে। ১৯৪১-১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন। ১৯৪৪-১৯৪৬ সাল অবধি তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর বা ভি. সি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা আরেকবার হাইকোর্টের বিচারপতি এই দুই ধরনের পেশায় বার বার তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন “law and mathematics are not so different after all।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হলে রাধাবিনোদ পালের জীবনে ঘটে যায় এক স্মরণীয় ঘটনা। ব্রিটিশ ভারত সরকার তাঁকে টোকিও ট্রাইব্যুনালের অন্যতম বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়। তিনি ১৯৪৬ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারক নিযুক্ত হন। ১৯৫২-৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের সদস্য ছিলেন। এর মাঝে ১৯৬২ সালে তিনি আবার আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তিনি তিন বার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেগোর প্রফেসর অফ ল; ব্রিটিশ ভারত সরকারের ইনকাম ট্যাক্স বিষয়ে লিগ্যাল অ্যাডভাইজার এবং একবার ‘International Academy of Comparative Law’-এর যুগ্ম সভাপতি ছিলেন।
লেখক:
মো. জাবেদ ইকবাল
সহকারী অধ্যাপক
বাংলা বিভাগ
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ
ইতিহাসের বিস্মৃত বাঙালি বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল – ২য় পর্ব।
ইতিহাসের বিস্মৃত বাঙালি বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল – ৩য় ও শেষ পর্ব।
মূল্যায়নের মরীচিকায় অবমূল্যায়িত প্লেটো।
৭ই মার্চের ভাষণ: স্বাধীনতার ওঙ্কার।