এসএম রুবেল ক্রাইম রিপোর্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে।।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলাজুড়ে বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন এক কথিত ও ভুয়া কাজি। শিবগঞ্জ পৌরসভার দেওয়ান জায়গীর গ্রামের মৃত সাজুর উদ্দিনের ছেলে ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মসজিদের ইমাম নূর মোহাম্মদ লালুর বাল্যবিয়ের কাণ্ডে বেকায়দায় ও বিপাকে পড়েছেন রেজিষ্ট্রেশনকৃত আসল কাজিরা। বারবার জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও নিকাহ রেজিস্ট্রারের নিকট অভিযোগ দিলেও ভুয়া মিলছে না সুরাহা।
শিবগঞ্জ উপজেলার প্রকৃত ও রেজিস্ট্রারকৃত কাজিদের অভিযোগ, নিজেকে কাজি পরিচয় দিয়ে শিবগঞ্জ উপজেলা বিভিন্ন ইউনিয়নে ইউনিয়নে গিয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বাল্যবিয়ে সম্পন্ন করেন নুর মোহাম্মদ লালু। এনিয়ে বিভিন্ন ইউনিয়নে প্রকৃত কাজি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাকে একাধিক হাতেনাতে ধরার পর ভুল স্বীকার করে এই পথ থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি দিলেও কিছুদিন পর তা আবার শুরু করেন।
এদিকে, প্রতিবেদক পরিচয় গোপন করে গোপনে একটি বিয়ে পড়ানোর কথা বললে মুঠোফোনে তার সবকিছুই অকপটে স্বীকার করেন ভুয়া কাজি নুর মোহাম্মদ লালু। এসময় তিনি জানান, দেশের প্রচলিত আইনে ছেলে বা মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক না হলে এটি রাজশাহী কোর্ট থেকে বিয়ের কাগজপত্র করতপ হবে। সেক্ষেত্রে খরচ বাড়তে পারে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজশাহী কোর্টের আইনজীবীর নাম করে সিলমোহর তৈরি করে নিজেই এসব কর্মকাণ্ড করেন নুর মোহাম্মদ লালু। এভাবেই একটি এফিডেভিট তৈরি করে বাল্যবিয়েকে করে দেন বৈধ। জানা যায়, রেজিস্ট্রারকৃত বৈধ বিয়েতে লাখ টাকা দেনমোহরে ১৪০০ টাকা কাজির ফি হলেও নুর মোহাম্মদ লালু টাকা নেন ইচ্ছেমতো। প্রত্যেকটি বাল্যবিয়েতে তিনি নেন ৩৫০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকা।
অনুসন্ধানে গতবছরের ১৬ আগষ্ট একটি বাল্যবিয়ে পড়ানোর এফিডেভিট হাতে আসে প্রতিবেদকের কাছে। সেখানে দেখা যায়, শিবগঞ্জ উপজেলা কানসাট গ্রামের ২১ বছর বয়সী এক ছেলে ও একই উপজেলার দেবীনগর গ্রামের এক ১৮ বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে করিয়ে দেন ভুয়া কাজি নুর মোহাম্মদ লালু৷
বিয়ে করা ওই ছেলে বলেন, আমাকে কাজি পরিচয় দিয়ে বিয়ে করান৷ এমনকি কাবিননামা করে দিবেন বলেও অতিরিক্ত টাকা নেন। অথচ রাজশাহী কোর্টের একটি এফিডেভিট ছাড়া আর আমাদেরকে কিছুই দেননি। দিব দিব বলে দীর্ঘদিন ধরে ঘুরাচ্ছেন। সে আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে। তার উপযুক্ত শাস্তি দাবি করছি।
মনাকষা এলাকার বাল্যবিয়ে করা এক যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্থানীয় এক মৌলভীর কাছে কাগজপত্রসহ বাল্যবিয়ে করিয়ে দিতে পারেন এমন কাজি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন নুর মোহাম্মদ লালুর সাথে। পরে তার কাছে প্রায় ৪ হাজার টাকা খরচ করে বিয়ে করি। কিন্তু একটি এফিডেভিট ছাড়া সে আর কিছুই দিতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বিয়ের খবর জানাজানি হলে কাবিননামা দেখাতে না পারায় আমরা একসাথে দীর্ঘ দুই মাস সংসার করলেও স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিতে পারছি না। এমনকি মেয়ের বাবা আমার নামে মামলা করেছে, কারাগারেও যেতে হয়েছে আমাকে। নুর মোহাম্মদ লালু আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে।
সম্প্রতি তার নিজ এলাকায় কাজি সেজে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে একটি বিয়ে পড়িয়েছেন নুর মোহাম্মদ লালু। বিষয়টি স্বীকার করে ওই কিশোরীর মা বলেন, নুর মোহাম্মদ লালু বিয়ে পড়িয়েছেন। কাজি হিসেবে তিনি পাঁচ হাজার টাকাও নিয়েছেন।
বিনোদপুর ইউনিয়নের রেজিষ্ট্রেশনকৃত সরকারি কাজি ফারুক কাজি বলেন, গত প্রায় ২ বছর আগে আমার এলাকায় একটি বিয়ে পড়ানোর সময় তাকে আটক করা হয়। পরে স্থানীয়রা ভুয়া কাজি জানতে পেরে মারধরও করে। সেসময় নিজের ভুল স্বীকার করে আর কোন বিয়ে পড়াবেন না বলে সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে আসেন। এরপর আবার শুরু করেন বালবিয়ে পড়ানোর ধান্দা।
তিনি আরও বলেন, বিয়ের জন্য সাধারণত জনসাধারণ আমাদের কাছেই প্রথমে আসে। কিন্তু বয়স কম থাকলে আমরা ফিরিয়ে দেয়ার পর সেই সুযোগ নেই ভুয়া কাজি নুর মোহাম্মদ লালু। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নিজেই বিয়ে পড়িয়ে আদালতের একটি ভুয়া এভিডেভিড করে দেয়। যার আইনগত কোন ভিক্তি নাই।
মনকষা ইউনিয়নের কাজি মো. মাহফুজ জানান, সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও প্রশাসন এতো কঠোর হওয়ার পরে বাল্যবিয়ে রোধ করা যাচ্ছে না। নিজেই মৌলভী, নিজেই কাজি নুর মোহাম্মদ লালু। শুধু লালুই নয়, তার মতো আরও কিছু ভুয়া কাজি আছে শিবগঞ্জ উপজেলায়। তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তা না হলে কোনভাবেই রোধ করা যাবে না বাল্যবিয়ে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিকাহ রেজিস্ট্রার কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুল বারী বলেন, ভুয়া কাজীর এমন কর্মকান্ডে আমার জেলা প্রশাসক মহোদয়কে বারবার অভিযোগ দেয়ার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে নোটার পাবলিকের কার্যালয় থেকে এভিডেভিট কিছুটা হলেও কমেছে। তাই ভুয়া কাজীরা এখন রাজশাহী নোটার পাবলিকের কার্যালয় থেকে এভিডেভিট করছে। রাজশাহী নিকাহ রেজিস্ট্রার কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে এই বিষয়ে সীধান্ত হয়েছে, তা বন্ধ করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার।
শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এএফএ আবু সুফিয়ান বলেন, এবিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কারন বাল্যবিয়ে রোধে আমরা তৎপর রয়েছি। আর সেই কাজ করলে তার কোন ছাড় নেই। প্রয়োজনে জেলা রেজিস্ট্রারকেও এবিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হবে।
প্রসঙ্গত, বাল্যবিয়ে হলো অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির আনুষ্ঠানিক অথবা অনানুষ্ঠানিক বিয়ে। বাংলাদেশে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭’ অনুযায়ী মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ এবং ছেলেদের ২১ বছর। এর আগে বিয়ে করলে সেটি বাল্যবিয়ে বলে গণ্য হবে।